বিজ্ঞানের প্রথম পাঠ
ছোটবেলায় আমার পড়া জাফর ইকবাল স্যারের প্রথম বই খুব সম্ভবত বিজ্ঞানের একশ’ মজার খেলা।

শিরোনামটা অ্যাপ্রোপ্রিয়েট- বইটার বিষয়বস্তু হল অনেকগুলো সায়েন্টিফিক “এক্সপেরিমেন্ট”, কিন্তু এক্সপেরিমেন্টগুলো এতই সহজসরল যে এদের খেলা বলাই ভাল। কয়েকটা উদাহরণ:
২৫। বড় বল ছোট বল
একটা বড় বলের (ফুটবল) উপর একটা ছোট বল (টেনিস বল) রাখ, তারপর বল দুটি সাবধানে শক্ত মেঝেতে ফেল। দেখবে ছোট বলটি ভয়ংকর জোরে উপরে ছুটে যাবে, যদি সাবধান না থাক খারাপভাবে ব্যথা পেয়ে যেতে পার! এর কারণটি খুব সোজা, বড় বলটি মেঝেতে আঘাত খেয়ে উপরের দিকে উঠে ঠিক একটা ব্যাটের মতো ছোট বলটাকে আঘাত করে শূন্যে ছুটিয়ে দেয়।
৫৪। বরফ তোলা
এক টুকরা বরফকে স্পর্শ না করে সেটাকে কি উপরে তোলা যায়? খুব কঠিন নয় ব্যাপারটা, একটা সূতার খানিকটা বরফের উপরে রেখে তার উপর অল্প একটু লবণ ছিটিয়ে দাও। বরফের সাথে লবণ মিশিয়ে দিলে তার গলনাংক কমে যায়, কাজেই উপরের বরফটা গলে যাবে, খুব বেশি লবণ দেয়া হয় নি তাই আশেপাশের বরফের জন্যে উপরের পানিটা একটু পরে আবার যখন জমে যাবে তখন সুতাটা বরফে আটকে যাবে। এবারে সুতা ধরে বরফটাকে টেনে তুলে আনা কঠিন কিছু নয়।
আজকাল দেশে যে সায়েন্স কিটগুলো পাওয়া যায় সেগুলোতে বোধহয় একটু ইঞ্জিনিয়ারিং এর গন্ধ আছে- সাধারণত কোন একটা পর্যায়ে গিয়ে সার্কিট বানিয়ে কিছু একটা করতে হয়। এসব জিনিসের লিমিটেড অ্যাক্সেসিবিলিটির কথা চিন্তা করে স্যার ইচ্ছা করেই এই বইতে সেসব দিকে জাননি। তার ‘খেলা’গুলোর বিষয়বস্তু ছিল কাগজ সর্বোচ্চ কয় ভাঁজ করা যায় বা পানিতে পয়সা ফেললে কীরকম দেখায়- এই পর্যায়ের। সেভাবে দেখলে বইটা একটা সায়েন্সের গন্ধঅলা ম্যাজিক ট্রিকসের বই।

এবার চলেন বইটা নিয়ে একটু ত্যানা প্যাঁচাই। এরকম একটা বইয়ের মূল মেসেজটা আসলে কী?
এটার সরলসোজা উত্তর হল- বিজ্ঞান ভীষণ মজার একটা জিনিস, অনেকটা ম্যাজিকের মত। কাজেই এটা বাচ্চাদের বিজ্ঞান ভাল লাগাতে সাহায্য করবে। লেখক বইয়ের মুখবন্ধে সেটাই লিখেছেন।
কিন্তু এই মেসেজটার একটা সমস্যা আছে- বিজ্ঞানের অনেক বিষয়ই আছে যেটা সাধারণ্যের কাছে চূড়ান্ত বোরিং এবং কিছুক্ষেত্রে সময় নষ্ট মনে হবে, আর এই বিষয়গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আসে বিজ্ঞান শিক্ষার গোড়ার দিকে। জাফর ইকবাল স্যারের বইয়ের সায়েন্স-ম্যাজিকের সাথে হাই স্কুল লেভেলের ক্রেবস সাইকেল আর ফুলের মর্ফোলজির কোন মিল নেই। কিন্তু বিজ্ঞানকে চিনতে আর ভালবাসতে হলে স্কুল কলেজের বিজ্ঞান ক্লাসে বসে এই সাংঘাতিক বোরিং ছাইপাশগুলো জানতেই হবে। সমস্যাটা সেখানেই: বিজ্ঞানের এসব মজার খেলা বিজ্ঞানের “কুল” ব্যাপারগুলোকে ভালবাসতে শেখায়, আপাতঃ বোরিং দিকগুলোকে নয় (নিচের কমিক দ্রষ্টব্য)।

তবে এটা বাদ দিলেও বইয়ের খেলাগুলোর আরেকটা মেসেজ আছে। প্রত্যেকটা খেলারই মূল বক্তব্য এরকম- আমরা যা দেখছি তা সাধারণ বোধবুদ্ধি বা কমন সেন্সের বিপক্ষে যায়। কমন সেন্স বলে- এক টুকরো টিস্যু পেপার আগুন ধরলে সেটা সাথে সাথে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আমি যদি একটা পয়সাকে টিস্যু পেপার দিয়ে মুড়ে আগুনে ধরি- তাহলেও সেটা পুড়ে না যাওয়ার কোন কারণ নেই, কারণ এক্ষেত্রেও টিস্যুটাকে সরাসরি আগুনের মধ্যেই ধরা হচ্ছে। আসলে যে পয়সাটার হিট কনডাক্টিভিটি বেশি হওয়ার কারণে সেটা সমস্ত তাপ সরিয়ে নিয়ে যাবে এবং টিস্যুটার একটুও ক্ষতি হতে দেবে না- কমন সেন্স বা সাধারণ লজিক দিয়ে সেটা ধরা সম্ভব নয়।
এখান থেকে আমরা দু’টো মেসেজ পাই। প্রথমত, অনেক ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক আইনকানুন আমাদের কাছে “অযৌক্তিক” মনে হবে। আর দ্বিতীয়ত, তা সত্ত্বেও বৈজ্ঞানিক সত্যই ধ্রুব, ব্যক্তিগত বোধবুদ্ধি বা ‘লজিক’ নয়। সত্য জানার প্রক্রিয়াগুলোর একটা লিস্ট করতে বসলে কমন সেন্সের ওপরে বৈজ্ঞানিক নিয়মকে স্থান দিতে হবে, কমন সেন্সের সাথে কনফ্লিক্ট চুলোয় যাক।
বৈজ্ঞানিক আইনকানুন বা প্রক্রিয়ার ওপর এই যে আস্থা- আমার নিজের কাছে অযৌক্তিক মনে হইলেও তোমাকে আমি মানিব- এটাই বিজ্ঞান শিক্ষার প্রথম পাঠ। বিজ্ঞানের ওপর এই বিশ্বাসের একটা সুন্দর ডেমোন্সট্রেশান দেখতে ওয়াল্টার লিউইনের এই দুই মিনিটের ক্লিপটা দেখে ফেলতে পারেন:
আমরা যারা ল্যাবে কাজ করি, তারা অনেক ক্ষেত্রেই ভুলে যাই আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম সাধারণ বুদ্ধিতে কতটা অদ্ভুত আর অযৌক্তিক দেখায়।
মনে করুন আমার কাছে একটা স্যাম্পল আছে, আমি সেখান থেকে একটা জানা জিনের ডিএনএ সিকোয়েন্স বের করতে চাই। সেটা করতে গেলে আমি করি? সাধারণত পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশান দিয়ে জিনটাকে অ্যামপ্লিফাই করে সিকোয়েন্সিং ফ্যাসিলিটিতে পাঠাই। এখন এই যে পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশান- এটা কিন্তু শুধুমাত্র কয়েকটা তরল জিনিস একসাথে মিশিয়ে একটা স্পেশাল সিস্টেমে তাপ দেওয়া বই কিছু নয়। তরল জিনিসগুলোর কোনটারই কোন রঙ নেই (কিছু ব্যতিক্রম বাদে), আর পুরো মিশ্রণটা দেখতেও নেহায়েতই পানির মত। যখন একটা তরলের সাথে আরেকটা তরল মেশানো হয়, তখন বোতলের গায়ে লেবেলের ভিত্তিতে আমরা ধরে নেই যে অমুক কৌটোয় তমুক জিনিস আছে, কাজেই এটা অমুকের সাথে তমুক টাইপের বিক্রিয়া করবে। বিজ্ঞানের সাথে কোন ধরণের যোগ নেই এমন কেউ যদি পুরো প্রক্রিয়াটা দেখেন, তার কাছে এটা নিতান্তই ছেলেমানুষি মনে হবে। গল্পের ডাইনি যখন শরবত বানানোর সময় এটা-ওটা মেশায়, তখন তাও জিনিসগুলো দেখে বোঝা যায় যে বেড়ালের লেজের সাথে বুনো ফুলের ডাটা মেশানো হচ্ছে। কিন্তু মলিকিউলার বায়োলজির কাজ দেখলে মনে হবে- এরা সারাদিন শুধু পানির সাথে পানি মেশায়। পুরো প্রক্রিয়াটার মাঝে কোন অর্থ খুঁজে পাওয়ার জন্য বিজ্ঞানের প্রতি একটা সাংঘাতিক লেভেলের বিশ্বাস থাকা দরকার।
আমার আগের ল্যাবের এক ভাই এরকম কাজ শেখানোর সময় বলতেন- ঈমান শক্ত রাখতে হবে।
এই বিশ্বাসে বস্তু তখনই মেলায় যখন সিকোয়েন্সিং ফ্যাসিলিটি থেকে জিন সিকোয়েন্সের ফাইল পাঠায়। ফাইলটার মধ্যে তারা আমার জিন অ্যানালিসিস করে যে সিকোয়েন্স বের করেছে, সেটা ডিএনএর চার অক্ষরে লেখা থাকে। আমরা সেই সারি সারি বর্ণমালাকে ডেটাবেজের সাথে মিলিয়ে দেখি।
আমার গোড়ার স্যাম্পলে যে আসলেই এই জিন আছে, সেটা প্রমাণ হবে যদি ফ্যাসিলিটি থেকে পাঠানো বর্ণমালা ডেটাবেজের বর্ণমালার সাথে মিলে যায় (কিছু এদিক ওদিক থাকা অস্বাভাবিক নয়)। জিনের দৈর্ঘ্য যদি তিনশ’ বর্ণমালা হয় (বেশ ছোট সাইজ), তাহলে দু’টো সিকোয়েন্সের দৈব চয়নে মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা মোটামুটি ৫,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ ভাগের এক ভাগ (একশ’ আশিটা শূন্য)। কনটেক্সটের জন্য ভাবুন: আপনার মাথায় চুলের সংখ্যা লিখতে একের পর পাঁচটা শূন্য বসাতে হয়, পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রে পানির ফোঁটার সংখ্যা লিখতে পঁচিশটা, আর গোটা মহাবিশ্বে কণার সংখ্যা লিখতে আশিটা। দু’টো ছোট সাইজের সিকোয়েন্স মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা এই সবকিছুর চেয়ে অকল্পনীয় বেশি।

এটা দেখলেই আমরা নিশ্চিন্ত হই- যাক, তাহলে এতদিন যা করে এসেছি সেটা পাগলামি নয়, কৌটোগুলোতে আসলেই সিরিয়াস কিছু তরল ছিল, যেগুলো মিশিয়ে তাপ দেওয়ার ফলে আসলেই স্যাম্পলে থাকা ডিএনএ বিক্রিয়া করেছে। সেই বিক্রিয়ার প্রমাণ হল এই ফাইল।
বরং কেউ যদি বলে যে এতদিনের কাজ ভুল, তাহলে সে যে ঠিক কতখানি মিথ্যা বলেছে সেটা দেখানোর জন্য একশ’টা মহাবিশ্ব বোঝাই কণার সংখ্যা লাগবে।