পুঁজিবাদ ও টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন

Hassan uz-Zaman
3 min readNov 10, 2019

--

যদি প্রশ্ন করা হয়- পুঁজিবাদী আদর্শের সবচেয়ে বড় শত্রু কে?

এর উত্তরে প্রথমে হয়ত আসবে Das Kapital, কিন্তু তারপরেই আসবে যে জিনিসটা তা হল টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন। কেন সেটা বোঝার জন্য প্রথমে মনে রাখতে হবে- আধুনিক বিজ্ঞান বা উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মত পুঁজিবাদ ব্যাপারটাও Enlightenment যুগের ফসল। পুঁজিবাদী আদর্শ ধরে নেয়- মুক্তবাজারের ক্রেতা-বিক্রেতা তাদের নিজেদের বৈষয়িক মঙ্গল কিসে নিয়ে আসবে, সেটার বিচারে যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। এই বিচক্ষণতা বা মানসিক পরিপক্বতা আছে বলেই তারা বোঝে কোন লেনদেনে তার লাভ কতখানি। লোভ যদি পুঁজিবাদী ইঞ্জিনের জ্বালানি হয়ে থাকে, তবে বিচক্ষণতা, যৌক্তিকতা বা প্রজ্ঞা হচ্ছে সে ইঞ্জিনের ড্রাইভার।

পুঁজিবাদী দার্শনিকরা বলে থাকেন- বিক্রেতা যদি ভাল মানের কিছু বাজারে আনতে না পারেন, তাহলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থায় তিনি টিকবেন না। কিন্তু তার জন্য বাজারকে হতে হবে যৌক্তিক বা প্রজ্ঞাবান, যাতে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সম্মিলিত বিবেচনায় ভাল জিনিসের মান আসলেই ভাল প্রতীয়মান হয়। বাজারব্যবস্থায় এই যুক্তি বা প্রজ্ঞার স্বীকার্য আছে বলেই প্রতিযোগী বিক্রেতারা বাজারে যুদ্ধ করে জেতার মোটিভেশান পান। এই স্বীকার্য পুঁজিবাদের সফলতার জন্য এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, যেখানে দেখা যায় ক্রেতারা বাজারে যথেষ্ট প্রজ্ঞা বা বিবেচনার পরিচয় দিতে পারছেন না, সেখানে ক্ষেত্রবিশেষে আইন করে লেনদেন নিষিদ্ধ করা হয়। এই কারণেই শিশুরা চুক্তিবদ্ধ হতে পারে না। বিক্রেতারা যাতে তাদের পণ্য নিয়ে সঠিক তথ্য দেন, সেটা নিশ্চিত করার জন্যও আইন প্রণয়ন করা হয়। কারণ ঐ একই- ক্রেতা যদি পণ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য না পান, তাহলে তারা যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নেবেন কীভাবে?

তো এই পুঁজির চর্চায় কি অসঙ্গতি নেই? আলবৎ আছে- কার্টেল বা একচেটিয়াপনা মুক্তবাজারকে ব্যাহত করে। কিন্তু টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন একে শুধু ব্যাহতই করে না, ভেঙ্গে টুকরো করে। খুব সহজ একটা উদাহরণের কথা ভাবুন। যে কোন বিষয়ে (ব্যবসা বা অন্য কিছু) যে কোন ধরণের বক্তব্যের যৌক্তিকতা যদি আমরা বিবেচনা করতে চাই, তবে সে বক্তব্য অতি অবশ্যই ভাষায় প্রকাশযোগ্য হতে হবে। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, বক্তব্যটাকে হতে হবে একটা প্রস্তাবনা বা proposition। কারণ সত্য/মিথ্যা বিচার করা যায় শুধু প্রস্তাবনার ক্ষেত্রেই। আবেগের ট্রুথ ভ্যালু সত্যক সারণি থেকে পাওয়া যাবে না। তো কোন বক্তব্যকে যদি এভাবে প্রস্তাবনা আকারে পেশ করা না হয়, তাহলে এর ওপর কোন ধরণের গবেষণা বা যুক্তির ছুরিকাঁচি চালানো সম্ভব নয়। প্রজ্ঞার মূল্য শুধুমাত্র প্রস্তাবনার ক্ষেত্রেই।

ব্যাবসায়িক বিজ্ঞাপনে প্রস্তাবনা জিনিসটার কদর হ্রাস পাওয়া শুরু করেছে উনিশ শতকের শেষ থেকেই, তবে টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন জেঁকে বসার আগ পর্যন্ত প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ হয় নি। এই বিজ্ঞাপনে ভাষা বা প্রস্তাবনার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে ছবি। সচিত্র বিজ্ঞাপনের সার্থকতা নির্ভর করে ক্রেতার আবেগের ওপর, পণ্যের গুণাগুণ সংক্রান্ত যৌক্তিক বিবেচনার ওপর নয়। আজকের টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে প্রস্তাবনা জিনিসটা ঠিক অসুন্দর চেহারার মতই দুর্লভ। বিজ্ঞাপকের বক্তব্য কি ঠিক না ভুল সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। এখনকার একটা ম্যাকডনাল্ড বিজ্ঞাপনের কথা চিন্তা করুন- এখানে যুক্তির ধারাক্রম বা যাচাই করে নেওয়ার মত প্রস্তাবনা, এরকম কিছুই নেই। ম্যাকডনাল্ডের বিজ্ঞাপন একটা পৌরাণিক নাটক, যেখানে দৃষ্টিনন্দন কিছু মানুষ হ্যামবার্গার কিনে খাচ্ছেন এবং খাওয়ার পর তীব্র আনন্দে অভিভূত হয়ে যাচ্ছেন। এই নাটকের নীতিকথা ক্রেতা নিজে যা ধার্য করেন তাই। টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন পছন্দ বা অপছন্দ করা যায়, কিন্তু খণ্ডন করা যায় না।

আসলে টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন পণ্যের মানের বিজ্ঞাপন নয়। টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন ক্রেতার মানসিকতার বিজ্ঞাপন। চলচ্চিত্রের তারকা বা বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ, দৃষ্টিনন্দন পটভূমি, রোমান্টিক সান্ধ্যভোজ, সুন্দর পরিবার একসাথে পিকনিকে যাচ্ছেন- এগুলোর কোনকিছুর সাথেই পণ্যের কোন সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে ক্রেতাদের মানসিকতা- তাদের আশা, ভয়, ভালবাসা, অপছন্দ, স্বপ্ন- ইত্যাদির সাথে কিন্তু এগুলোর সবকিছুরই সম্পর্ক আছে। বিজ্ঞাপকের তার নিজের পণ্যের গুণাগুন সম্পর্কে জানার প্রয়োজন নেই, যেহেতু তিনি ক্রেতার মনস্তত্ত্ব জানেন। এ জন্যই আজকাল ব্যবসার খরচ পণ্য গবেষণায় যতটা, তার চেয়ে বেশি বাজার গবেষণায়। টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন ব্যবসার গতিবিধিকে পণ্যের মানের দিকে রাখে নি, রেখেছে ক্রেতারা যাতে নিজেদের মানসম্পন্ন মনে করেন সেদিকে। তার মানে ব্যবসা আজ শুধু ব্যবসা নয়, সে এখন থেরাপি, যার লক্ষ্য হচ্ছে রোগী অর্থাৎ ক্রেতাকে সাইকোড্রামা দেখিয়ে আশ্বস্ত করা।

— — — — — — — — — — — — —

মূল: নিল পোস্টম্যানের Amusing Ourselves to Death: Public Discourse in the Age of Show Business। চ্যাপ্টার- Reach out and Elect Someone.

Sign up to discover human stories that deepen your understanding of the world.

Free

Distraction-free reading. No ads.

Organize your knowledge with lists and highlights.

Tell your story. Find your audience.

Membership

Read member-only stories

Support writers you read most

Earn money for your writing

Listen to audio narrations

Read offline with the Medium app

--

--

Hassan uz-Zaman
Hassan uz-Zaman

Written by Hassan uz-Zaman

Husband, biologist, philosophy enthusiast, nothing else much besides. In pursuit of happiness and understanding.

Responses (1)

Write a response