এডিংটনের দুই টেবিল
কিছুক্ষণ আগে আজ যখন মনস্থির করলাম- লেকচারগুলো এই বেলা লিখে ফেলা যাক- তখন আমার টেবিল দু’খানার সাথে চেয়ারগুলো ঠেকিয়ে দুই কলম হাতে নিয়ে বসে গেলাম। আমার আশেপাশের সবকিছুরই একটা করে জোড়া আছে- দুই টেবিল, দুই চেয়ার, দুই কলম।

অনেকেই হয়ত মনে করবেন- বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে লেকচার দিতে এসে এ ব্যাটা কি চেয়ার টেবিল জোড়ার কাহিনী শুরু করল। সমুদ্র অভিযানে এসে প্রথমেই অতল তলে পা ঠেকাবার আশা করা ঠিক নয়, প্রথমে পানির উপরিভাগটাও একটু নেড়েচেড়ে দেখতে হয়। কিন্তু সেই নাড়াচাড়াটা যখন করতে গেলাম, একটা ব্যাপারই প্রথম হাতে এসে ঠেকল- আমার দুই টেবিল।
এই টেবিলজোড়ার একখানাকে আমি খুব ভাল করে চিনি। এই টেবিল খুবই সাধারণ, একেবারেই নিত্যনৈমিত্তিক- আমার চেনা জগতেরই অংশ। কীভাবে এর বিবরণ দেই? এই টেবিলের একটা বিস্তার বা ব্যাপ্তি আছে, এটা মোটামুটি স্থায়ী, ভর দিলে নেতিয়ে পড়ে না, এর গায়ে একটা রঙ আছে, সবচেয়ে বড় কথা- এটা বাস্তব। বাস্তব মানে কী? যদি বলি, এই টেবিলটা বাস্তব- তার মানে হল এর একটা স্বকীয় “টেবিলত্ব” আছে। এটা একটা বস্তু, নেহায়েত জায়গা বা স্থান নয়- স্থান বলতে আমরা কিছু না-থাকাকেই বুঝি। আবার সময় বা কালও নয়- ঈশ্বর একাই জানেন সময় যে আসলে কী। টেবিলটা যে কী নয় তা বলে আমি এর “বাস্তবতা”র কোন অর্থ দাঁড় করাতে পারছি না। বাস্তবতা জিনিসটা যার থাকে, তাকেই বলে বস্তু, আর বস্তুর আদর্শ উদাহরণ হচ্ছে আমার এই টেবিলটা। এই চক্র থেকে বেরোনোর আসলে সেরকম উপায় নেই, আর এভাবে সংজ্ঞা টানতে থাকলে তো নয়ই।
আপনি যদি সাধারণ বুদ্ধির কেউ হয়ে থাকেন, এই প্যাঁচাল দেখে আপনার যথেষ্ট বিরক্ত হওয়ার কথা। টেবিল কী সেটা কে না জানে। এর প্রকৃতি বুঝতে এত সময় অপচয় করার কোন মানে নেই।
এবার তাহলে আসুন দুই নম্বর টেবিলে। এই টেবিলটা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক টেবিল। এর সাথে আমার পরিচয় খুব বেশিদিন হল হয়নি, আর আজ পর্যন্ত একে মেনে নিতে আমার খানিকটা অস্বস্তি হয়। ঘুম থেকে উঠে চোখ মেললেই যে জগতটা আমার দৃষ্টিতে এসে হাজির হয়, এই টেবিল সেই চেনা জগতের অংশ নয়। হাজার রকমের ভৌতিক যন্ত্রপাতি, লাখ রকমের প্যাঁচানো কলাকৌশল, আর কোটি রকমের স্বীকার্য-প্রস্তাব-উপপ্রমেয় দিয়ে টেবিলের জগতটা আমার মনমগজে চেপে বসানো।
আমার বৈজ্ঞানিক টেবিলটা আসলে একগাদা খালি জায়গা। এই খালি জায়গার মধ্যে হাজার হাজার কোটি কোটি খুদে বৈদ্যুতিক চার্জ নিরন্তর এখান থেকে ওখানে ছিটকে বেড়াচ্ছে। এই সব খুদকুড়ি চার্জ সমস্ত একজায়গায় করে ভর মাপলে টেবিলের মোট ভরের কোটি ভাগের একভাগও হবে না।
তবে গঠন যতই অদ্ভুত হোক- টেবিল হিসেবে এই দুই নম্বরটা একদম শতভাগ কার্যকর। প্রথম টেবিলের বিস্তারে কাগজ রেখে লিখে আমার যেরকম আরাম হয়, দ্বিতীয় টেবিলটাতেও তাই হয়- যদিও এক্ষেত্রে কোটি কোটি বৈদ্যুতিক কণা তীব্র বেগে কাগজের উল্টোদিকে আঘাত করে, আর সেই আঘাতগুলোর পৃষ্ঠতলে কাগজটা মোটামুটি স্থির হয়ে “ভেসে” থাকে। আমি এই টেবিলের ওপর ভর দিলে সে নেতিয়ে পড়বে না। আরেকটু নির্ভুলভাবে বলতে গেলে- এই বৈজ্ঞানিক টেবিলের ভেতর দিয়ে আমার বৈজ্ঞানিক কনুই-এর চলে যাওয়ার সম্ভাবনা এতই অসম্ভব কম যে, দৈনন্দিনের হিসেব-নিকেশে একে অগ্রাহ্য করা যায়। দু’টো টেবিল দিয়েই আমার যেকোন দিন কাজ চলে যাবে।
সমস্যায় পড়ব যদি কোনদিন বাসায় আগুন লাগে। আমার বৈজ্ঞানিক টেবিল সেই আগুনে খুবই স্বাভাবিক আচরণ করবে- সে বৈজ্ঞানিক সূত্র মেনে প্রাকৃতিকভাবেই বৈজ্ঞানিক ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাবে। কিন্তু আমার প্রথম টেবিলটাতে যদি আগুন লাগে, তাহলে যা ঘটবে সেটাকে অলৌকিকের কম কিছুই বলা যায় না- টেবিল তার টেবিলত্ব সঁপে দিয়ে ধোঁয়াত্বকে তার বাস্তবিক রূপ হিসেবে মেনে নেবে। এক বস্তুর আরেক বস্তুতে রূপান্তর, ঠিক যেমনটা শুঁয়োপোকা আর প্রজাপতির বেলায় ঘটে।
বৈজ্ঞানিক টেবিলে অবশ্য “বস্তুরূপ” বলে কিছু নেই। এটা নেহায়েতই একগাদা খালি জায়গা।
— — — — — — — — — — — — -
মূল: আর্থার এডিংটনের Nature of the Physical World থেকে নেওয়া।