ভলতেয়ারের বামুন
দুচ্ছাই, বৃথাই জন্ম এ জগৎ সংসারে- ঝাঁ করে একদিন বামুন বলে বসল।

কেন কেন? জন্ম বৃথা হতে যাবে কেন? শুধোলাম আমি।
বামুন বলল, আরে বাপু, এক-দেড় মাস নয়, চল্লিশ-চল্লিশটা বছর ধরে আমি পড়াশোনা করে আসছি, বুঝলে- আর এখন মনে হচ্ছে বছরগুলো স্রেফ নষ্ট হল। আমার অবস্থা দেখে আমি চুল ছিঁড়তে বাকি রেখেছি কেবল। এই পৃথিবীর কিচ্ছু আমার ভাল লাগে না- কিচ্ছু না। জীবন তো নয়, যেন সাক্ষাৎ বেতালকে কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছি।
এই যেমন ধর- আমার জন্ম আর বেঁচে থাকা সময়ের মধ্যেই, অথচ সময় যে আসলে কি-বস্তু, তা আজও জানিনি। পণ্ডিতেরা বলেন, অতীতে অসীম সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, যেমন যাবে ভবিষ্যতেও; অর্থাৎ দুই অসীমের মাঝে আমাদের অবস্থান। কিন্তু অসীমকে চেনা দূরে থাক, তার সম্পর্কে আমার ধারণামাত্র নেই। পদার্থ দিয়ে আমার শরীর গড়া- অন্তত সেরকমটাই মনে হয়- এদিকে চিন্তা-চেতনা-প্রজ্ঞা কিভাবে এল, এসম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোন সন্তোষজনক উত্তর পাইনি। প্রজ্ঞা কি কোন ক্ষমতা, নাকি চলাফেরা বা পরিপাক জাতীয় কোন তন্ত্র- এটা পর্যন্ত জানি না, এমনই দুরন্ত বে-ওয়াকেফ আমি। আমার জ্ঞানের দৌড় প্রজ্ঞা আর বুদ্ধির তত্ত্বকথা দূরে থাক, গতির তত্ত্ব পর্যন্ত ছুঁতে পারেনি। কেনই যে আছি আর কেনই বা এলাম সে এক অনন্ত রহস্য, আমার প্রত্যেকটা দিন কাটছে সেই রহস্যের পেছনে মাথা খুঁড়ে। কিছুই কি জানলাম? উত্তর আমার চাই-ই চাই, কিন্তু তার আশা যেন প্রতিদিনই নিভে আসছে। আমি কথা বলি প্রচুর, কিন্তু কথা শেষ করার পর নিজেই লজ্জিত বিভ্রান্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি।
ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন যদি কর- আরও বিপাকে পড়ব। ভগবান বিষ্ণু কি ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেছেন, নাকি তাঁরা উভয়ই অনাদিকাল থেকে ছিলেন? ঈশ্বর জানেন আমি নিতান্তই নির্বোধ, এ ব্যাপারে আমার জ্ঞান গ্রীষ্মকালের গঙ্গার মত হাঁটুতে এসে ঠেকে। মানুষ এসে আমায় প্রশ্ন করে, “ঠাকুর, জলে-জমিনে এতরকমের পাপ-দুষ্কৃতি-কষ্ট-বেদনা কেন জানাবেন?” জানাতাম, যদি সে হতভাগার চেয়ে আমার গম্যি বেশি হত। কখনও তাদেরকে বোঝাই- দেখো বাছারা, সবকিছুই তোমাদের ভালোর জন্য। বুড়ো বেতো পেটে-পাথরওয়ালা আর যুদ্ধে ঠ্যাং-হারানোদের কাছে সেটা ভীষণ বেখাপ্পা শোনায়, যেমনটা শোনায় আমার কাছেও।
মাথায় একরাশ কৌতূহল নিয়ে তখন ঘরে ফিরি- ভাবি সেই বৈদিক যুগের মুনিঋষিরা এই সব ঝামেলা ঘায়েল করে গেছেন। কিন্তু শাস্ত্র হাতড়ে আমার বিভ্রান্তি বাড়ে বৈ এতটুকু কমে না। আমার সমমনাদের সাথে এ ব্যাপারে কথা যখন বলি- দেখি আক্ষরিক অর্থেই নানা মুনির নানা মত। কেউ বলে- নিকুচি করি অত চিন্তার, ঋণং ঘৃত্য বহিং পঠেৎ, যাবং জীবেৎ সুখং জীবেৎ। অন্যেরা মনে করে তারা বেশ অনেক কিছু জানে, কিন্তু তাদের প্রস্তাব-উপপ্রমেয়-সিদ্ধান্তের জটিলতার শেষ মাথায় শুধু ছন্নছাড়া বিভ্রান্তি।
এই গোলকধাঁধায় যতই এগোই, পথের প্যাঁচ ততই বাড়ে, আর দিশে আরো বেশি করে হারায়। কি অন্তহীন হতাশা ভেবে দেখেছ? মাঝে মাঝে মনে হয় এই হতাশার কাছে হাল ছেড়ে দেই, আর তখনই মনে হয়- না তো, কিছুই তো জানা হল না। কে আমি? কোথা থেকে এলাম? কোথায় যাব? সেখানে আমার পরিণতি কি হবে? কিছুই জানি না, কিচ্ছু না।
বেচারাকে এই অবস্থায় দেখে আমার বেশ খারাপ লাগল, এর মত বুদ্ধিবাদী, সৎ, খোলামনের মানুষ আর কে থাকতে পারে? মনে হল, তার চিন্তার গভীরতা আর হৃদয়ের স্বচ্ছতাই এরকম পীড়ার কারণ।
ঐদিনই বামুনের এক বুড়ি প্রতিবেশীর সাথে আমার সাক্ষাৎ হল। আমি তাকে শুধোলাম, তোমার আত্মা কিভাবে এসেছে এ সম্পর্কে তুমি জান? এইসব চিন্তাভাবনা কি তোমাকে কষ্ট দেয়? বুড়ির কাছে আমার প্রশ্নটা বোধগম্যই হল না।
কপাল! বামুনমশাই যেসমস্ত উৎকট চিন্তায় হাঁপিয়ে মরছেন- একটিবারের জন্যও, জীবনের অসতর্কতম মুহূর্তটির জন্যেও এই বুড়ির মনে সেসব চিন্তার উদয় হয় নি! বুড়ি তার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভগবান বিষ্ণুকে বিশ্বাস করে এসেছে, গঙ্গা থেকে প্রক্ষালনের জন্য একঘটি পবিত্র জল পেলেই তার চাইবার আর কিচ্ছু নেই। চোখ বন্ধ করে একে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ তকমা দিয়ে দেওয়া যায়।
হতভাগীর সুখ দেখে ফিরলাম আমার সেই বামুনের কাছে।
মশাই, আচ্ছা মানুষ বটে তুমি। তোমার পঞ্চাশ গজের মধ্যে এক থুত্থুড়ে বুড়ি তোমার মত এসব কিচ্ছু ভাবছে না, অথচ তার জীবনে সুখের কমতি নেই। এভাবে কষ্টে দিন কাটিয়ে তোমার লাভটা হচ্ছে কি শুনি? শুধোলাম তাকে।
বামুন বলল, তা তুমি মন্দ বলনি। আজ পর্যন্ত আমি সহস্রবার নিজেকে বলেছি, আমার প্রতিবেশীর মত নির্বোধ হলেই আমার সব কষ্ট-দুঃখ-দুশ্চিন্তা চুকে যায়। কিন্তু ব্যাপারটা কি জান? এরকম সুখের আমার দরকার নেই।
পৃথিবী নামের এই নাট্যশালার অনেক কিছুই আমার মনে দাগ কেটে গিয়েছে, কিন্তু বামুনের এই উত্তরটার মত আর কিছুই নয়।
— — — — — — — — — — — — — -
মূল: ভলতেয়ারের The Good Brahmin. উইল ডুরান্টের The Story of Philosophy থেকে নেওয়া। পড়ুন এখানে- https://www.philosophicalsociety.com/Archives/Voltaire%27s%20Story%20Of%20The%20Good%20Brahmin.htm