ইউক্লিডের সমাপতন
দু’টো ত্রিভুজের দুই বাহু আর মাঝখানের কোণ যদি সমান হয়, তাহলে তারা সর্বসম (congruent); আর দু’টো ত্রিভুজ যদি সর্বসম হয়, তাহলে তারা সমান।
ইউক্লিড তার বোর্ডের সামনে। আঙ্গুল দিয়ে নির্দেশ করে বলে চললেন-
“ধরে নাও ABC ত্রিভুজকে DEF ত্রিভুজের ওপর চড়িয়ে দেওয়া হল। A বিন্দুকে যদি D বিন্দুর ওপর বসানো হয়, আর AB যদি DE বরাবর বসে, তাহলে B বসবে E এর ওপর, যেহেতু AB আর DE সমান।”
শিক্ষকসূলভ একটা প্রশান্তি তার চোখেমুখে। কিন্তু ছাত্ররা তাকে আর এগোতে দিল না।
“চড়িয়ে দেওয়া হল মানে? কে চড়িয়ে দিল, স্যার?”
“কীভাবে বসানো হবে, স্যার?”
“সমাপতন মানে?”
বার্ট্রান্ড রাসেল আর ডেভিড হিলবার্ট দু’জনেই মনে করতেন- ইউক্লিড তার চার নম্বর উপপাদ্যকে উপপাদ্য বানিয়ে একটা ভুল করেছেন। এটাকে তিনি একটা স্বীকার্য হিসেবে রাখলেই পারতেন। কিন্তু তা করলেও একটা গোঁজামিলের গন্ধ থেকেই যায়। ইউক্লিডের জ্যামিতির লজিক একদম ছুরির মত, এখানো কোন আপসের ঠাঁই নেই। যে মুহূর্তেই গণিতবিদ ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকা বিমূর্ত কিছুকে চড়ানো-বসানো-নাড়াচাড়া করার কথা বলবেন, তখনই এই কড়াকড়ি লজিকের সাথে তার বনিবনা হবে না। আকারের ওপর আকারের এই সমাপতন- এটা যদি উপপাদ্য হয়, তাহলে এই উপপাদ্য এমন কিছু স্বীকার্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যার কথা ইউক্লিড আগে বলেননি। অন্যদিকে এটা যদি স্বীকার্য হয়, তাহলে এই স্বীকার্যের পক্ষে ইউক্লিড কোনকিছু উপস্থাপন করছেন না। আর যদি ইউক্লিডিয় স্থানে আকারগুলোর চলাফেরা করার আলাদা কোন পদ্ধতি থাকে যেটার ওপর উপপাদ্যটাকে দাঁড় করানো হচ্ছে, তাহলে দু’টোই।
এই অস্বস্তিটা আরো ভালভাবে বোঝার জন্য মূর্ত (concrete) আর বিমূর্ত (abstract)- দুই প্রকারের আকৃতির দিকেই একটু তাকানো যাক। সমাপতনের যে ধারণাটা- এক আকারকে সরিয়ে আরেক আকারের ওপর ঠিকভাবে বসিয়ে দেওয়া- এ ব্যাপারটা কি আমাদের চেনাজানা মূর্ত জগতে হচ্ছে, নাকি ইউক্লিডের বিমূর্ত জগতে হচ্ছে? মূর্ত জগতে হওয়ার কথা নয় কিছুতেই, কারণ ইটপাথর লোহালক্করে বানানো দুই ত্রিভুজ কখনোই একদম ঠিক ঠিক সমাপতিত হবে না, তা যতই ক্যারিকেচার করে তাদের সরানো হোক না কেন। কোন এক দিকে এক চুল পরিমাণ হলেও ঢুকে বা বেরিয়ে থাকবে। দু’টো বস্তু কি কিছুতেই একদম নিখুঁতভাবে সমাপতিত হতে পারে?
নাকি ত্রিভুজগুলো বিমূর্ত? তাই যদি হয়, তাহলে তো তাদের কিছুতেই নড়াচড়া করার বা করানোর কথা নয়। বিমূর্ত জগত হচ্ছে সংখ্যা আর আকার-আকৃতি আর ধারণার জগত- তা সকল স্থান-কাল-পাত্রের উর্ধ্বে। তো স্থানের উর্ধ্বে যে জিনিস তার আবার নড়াচড়া কি?
চতুর্থ উপপাদ্যে এখন শুধু অস্বস্তিই নেই, এর গায়ে চিড়বিড়িয়ে ফাটল ধরা শুরু করেছে।
এসব বুঝেই রাসেল বলেছিলেন- ইউক্লিডিয় জ্যামিতিতে আসলে নড়াচড়া বা গতি বলে কিছু নেই। আমরা আসলে যেটাকে “নড়াচড়া” বলি, সেটা হচ্ছে এক আকৃতির থেকে আরেক আকৃতিতে আমাদের মনোযোগের স্থানান্তর। কিন্তু এই কথার মধ্যেই তো আরেকটা ভেজাল লুকিয়ে আছে- গণিতবিদের মনোযোগ এক আকৃতি থেকে আরেক আকৃতিতে স্থানান্তরের তখনই মানে থাকছে, যখন আকৃতিদু’টো সমান। সমান মানেই সর্বসম, সর্বসম মানেই ঘুরেফিরে সেই সমাপতন।
ইউক্লিডের জ্যামিতি যদি মূর্ত হয়, স্থান-কাল-পাত্রে বাধা থাকে- তাহলে এতে সমাপতন বলে কিছু নেই, কারণ সমাপতন বলে ইহলোকে কিছু সম্ভব নয়। যদি বিমূর্ত হয়- তবে সমাপতন কথাটার কোন মানেই নেই, কারণ বিমূর্ত মানেই স্থানের উর্ধ্বে।
— — — — — — — — — — — — — — —
মূল: ডেভিড বার্লিন্সকির The King of Infinite Space: Euclid and his Elements থেকে নেওয়া।